রাঙামাটিতে আয়নাঘরের সন্ধান

রাঙামাটি প্রতিনিধি :> ছাত্রলীগের বাপ্পি, তার ভাই ও হাসেম মিস্ত্রির ছেলে কায়সারসহ ৪ জন মিলে আমাকে হাত বেঁধে রুমে ফেলে রাখে। মারধর-নির্যাতনের পর হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে জ্ঞান হারাই। রাত ৩টার দিকে জ্ঞান ফেরার পর হাত খুলে দেয়। বেরিয়ে জানতে পারি, ৪ লাখ টাকা দেওয়ার পর আমাকে ছাড়া হয়। পরিবার জমি বিক্রি করে সেই টাকা দেয়। আমি গরিব মানুষ, জমিটিও হারালাম। আমি আমার টাকা ফেরত চাই, সন্ত্রাসীদের কঠিন শাস্তি চাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার ওপর ঘটে যাওয়া অমানবিক নির্যাতন ও দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথা বলছিলেন দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম। শুধু জাহাঙ্গীর আলম নন। রাঙামাটি শহরের বিএনপি অফিসের পাশে অবস্থিত নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের তৈরি টর্চার সেলে এমন হাজারো নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ী, শ্রমিকসহ বহু মানুষ। আটতলা বিশিষ্ট সাবা টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে একটি কক্ষে আয়নাঘর বানিয়ে চলতো এসব চাঁদাবাজি, বন্দী, শারীরিক নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা। ভবন, স্থাপনা নির্মাণ, জমি ক্রয়-বিক্রয়েও দিতে হতো চাঁদা। স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের ইভটিজিং, প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি, আড্ডাবাজি, সীমান্ত পার করে আনা ভারতীয় সিগারেট বিক্রিসহ নানা অপকর্ম চালাতো ওই ‘নরকরুমে’।

তবে নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ মেরে ফেলার হুমকি থাকায় ভয়ে মুখ খুলেননি কেউই। তবে ৫ আগস্টের পর সাহস বেড়েছে মানুষের। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আশা জাগাচ্ছে নির্যাতিত নিপীড়িত এসব মানুষদের। আর তাই প্রকাশ্য এসব নির্যাতন-নির্মমতার কথা বলছেন তারা, চাইছেন বিচার। পুলিশ বলছে, থানায় অভিযোগ দায়ের করলে আসামি গ্রেফতার ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এই টর্চার সেলের আসল চিত্র। স্থানীয়দের কাছে এখন ‘আয়নাঘর’ হিসেবেই পরিচিত। ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করা ওই আয়নাঘর বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি। জানালা দিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে একাধিক চেয়ার টেবিল ও বেঞ্চ। তবে এই কক্ষের অদূরে আরও একাধিক কক্ষ থাকলেও মানুষের চলাচল না থাকায় বিরাজ করছে ভুতুড়ে পরিবেশ।

মো. আখতার নামে অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, কাজ বন্ধ করার হুমকি দিয়ে বাপ্পিরা বলছিলো আমাদের সাথে ৫ লাখ টাকা লেনদেনের কথা হয়েছে। টাকা না দিলে কাজ চলবে না। ভয়ে কাজ বন্ধ করে দেই। কুলিং কর্নার দোকানদার আবদুল হক বলেন, চাঁদা না দেওয়ায় আমার দোকানের জিনিসপত্র লাথি মেরে ফেলে দেয়, মারতে চায়। এজন্য ওইদিন দোকান বন্ধ করেছি, আর খুলি নাই।

বদিউল আলম নামে অপরজন বলেন, আমার বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে বাপ্পি, কায়সার, রাকিব, রাব্বি ও কলিমুল্লাহ ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। না দেওয়ায় কাজ বন্ধ করে দেয়। রেজাউল করিম নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার মিস্ত্রীদের ধরে নিয়ে যায় আয়নাঘরে। মারধর করে তাদের মোবাইল ও টাকা-পয়সা লুটে নেয়। আমি কথা বলতে গেলে আমার মোবাইলও নিয়ে নেয়।

রবিউল হোসেন বাবলু নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, চাঁদা না পেয়ে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মৃত শাহ আলমের বাড়ি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় সন্ত্রাসীরা। এরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাওয়াল উদ্দিনের ভাগিনা। শাওয়ালের নেতৃত্বেই রাঙামাটিতে এসব অপরাধ চলতো। আমরা এখনও কোন বিচার পাইনি। কয়েকদিন আগে থানায় অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি।

স্থানীয় এলাকাবাসী বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাওয়াল উদ্দিনের নেতৃত্বে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি পিকআপের চালক হাবিবুর রহমান বাপ্পি, জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন কায়সার, ছাত্রলীগ নেতা মো. রাব্বী, মো. রাকিব ও কলিমউল্লাহ চাঁদাবাজি ও টর্চার সেল চালাতেন। শহরের আলম ডকইয়ার্ড এলাকায় এই সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ব, চাঁদাবাজি ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন এলাকাবাসী। ভয়ে মুখ খুলতেন না কেউই। তবে সম্প্রতি অপারেশন ডেভিল হান্টে অভিযুক্ত গ্যাংয়ের আনোয়ার হোসেন কায়সার চট্টগ্রামে আটক হয়েছেন। আর বাকিরা এখন পলাতক রয়েছেন।

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা। আলম ডকইয়ার্ডের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, যারা এখানে ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছেন তাদের কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক চাঁদাবাজি করা হয়েছে। তারা বিভীষিকাময় জীবন পার করেছেন। আরেক বাসিন্দা মো. কামাল বলেন, আমি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ভবিষ্যতে যেকোন সরকার আসলেও এ এলাকায় আর এসব চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ড যাতে না হয়।

জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মারুফ আহম্মেদ বলেন, দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার জন্য বিশেষ অভিযান চলছ। রাঙামাটিতেও চলমান অভিযানে বিভিন্ন অপরাধে ৫২ আসামিকে গ্রেফতার ও নিয়মিত মামলা রুজু করেছি। কারো আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে থানায় অভিযোগ দায়ের করলে আসামি গ্রেফতার ও যথাযথ আইনগত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।