আর কদিন পর পবিত্র রমজান মাস। সারা দিন রোজা রেখে ইফতারের সময় খাবারের তালিকায় বেশিরভাগের প্লেটে থাকে ছোলা। সারা বছর এর চাহিদা থাকলেও রমজানে তা বেড়ে যায় বহুগুণ। যে কারণে ক্রেতাদের চাহিদা মাথায় রেখে বাজার ধরতে রমজানের দুয়েক মাস আগ থেকে আমদানি করা হয় ইফতারের এ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তবে গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এবার দ্বিগুণ ছোলা আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। রমজান ঘিরে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এরই মধ্যে ভালো প্রস্তুতি দেখা গেছে। গত ৭ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতেই সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি করা হয়, যা ছয় মাসের চেয়েও বেশি।
ছোলার মজুত বাড়ায় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে বলে ধারণা করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে প্রতি মণে ৬২০ টাকা করে কমেছে ছোলার দাম, যা খুচরা বাজারে ভালোই প্রভাব ফেলতে পারে। তবে প্রশাসনের তদারকির ঘাটতি থাকলে সিন্ডিকেটের কারণে হয়তো স্বস্থির ছোলা অস্বস্থির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বাজার বিশ্লেষকদের।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মো. শাহ আলম কালবেলাকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্য আমদানির পরিমাণ খুবই বেশি। গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত ছোলা আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৩২ মেট্রিক টন। এ অর্থবছরের (২০২৪-২৫) এখনো আরও পাঁচ মাস সময় বাকি। এ সাত মাসেই আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ছোলা। মূলত আমদানিকারকদের আগ্রহের পাশাপাশি দেশের চাহিদা অনুযায়ী আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমদানি অব্যাহত থাকলে আশা করি সামনের রমজানে ছোলা নিয়ে ঘাটতি সংকট হবে না।
গতকাল খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোজা শুরুর চার মাস আগে থেকে আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি বাড়াতে এলসি মার্জিন শিথিল করা, চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১৫ শতাংশ কমানো, ভোজ্যতেলে ভ্যাট ৫ শতাংশ কমানো, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে এবার বেশি পরিমাণে এলসি (ঋণপত্র) খুলেছেন আমদানিকারকরা। সরবরাহ বাড়ায় পাইকারিতে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। এর সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পেতে খুচরা দোকানগুলোতে বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন পাইকাররা।
চাক্তাইয়ের খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংক সচল হওয়া ও তারল্য বাড়ায় আমদানিকারকদের এলসি খোলার হার বেড়েছে। এরই মধ্যে অনেক ভোগ্যপণ্য খাতুনগঞ্জে চলে এসেছে। সরবরাহ বাড়ায় দাম কমেছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে প্রতি মাসে গড়ে ছোলার চাহিদা ১০ হাজার টন; কিন্তু রমজানে এই চাহিদা ১০ থেকে ১২ গুণ বেড়ে হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টন। বছরে দেশে ছোলার চাহিদা ২ লাখ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। পাশাপাশি রাশিয়া, ইউক্রেন, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, কানাডা, ভারত, মিয়ানমার ও তাঞ্জানিয়া থেকেও ছোলা আমদানি করে আসছেন আমদানিকারকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে ছোলার দাম কম ছিল। এটির সুযোগ নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ জন্য শুধু ডিসেম্বরেই ছোলা এসেছে ১৫ হাজার ৫৮৭ টন। আর চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এসেছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ছোলা।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে আমদানি করা হয়েছে ৫ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন ছোলা। এর আগের অর্থবছরে জুলাইয়ে আমদানি করা হয় মাত্র ২২৫ মেট্রিক টন। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের আগস্টে আমদানি করা হয়েছে ২ হাজার ২৩০ মেট্রিক টন ছোলা। কিন্তু আগের অর্থবছরের আগস্টে আমদানি করা হয়নি কোনো ছোলাই। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরেও আগের বছরের চেয়ে ১ হাজার ৮৯৫ মেট্রিক টন ছোলা বেশি আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে আমদানি করা হয়েছে ২ হাজার ১৯৭ মেট্রিক টন। আর আগের অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ৩০২ মেট্রিক টন ছোলা। সেপ্টেম্বরে ছোলা আমদানি বাড়লেও অক্টোবরে তা কিছুটা কমে যায় চলতি বছর। এ অর্থবছরের অক্টোবরে ছোলা আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। আর আগের অর্থবছরের অক্টোবরে আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫২৬ মেট্রিক টন। তবে নভেম্বরে আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এ মাসে আমদানি হয় ৩ হাজার ৮৮৫ মেট্রিক টন ছোলা। আর এর আগের অর্থবছরের নভেম্বরে আমদানি করা হয় ৩ হাজার ৪৭৬ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি করা হয় ১৫ হাজার ৫৮৭ মেট্রিক টন ছোলা। আর তার আগের অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি করা হয় মাত্র ৬ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন ছোলা। অর্থাৎ ডিসেম্বরে আগের চেয়েও বেশি আমদানি করা হয় ৮ হাজার ৯৪৭ মেট্রিক টন ছোলা। আর চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে আমদানি করা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৪ মেট্রিক টন ছোলা। অন্যদিকে গত অর্থবছরের জানুয়ারিতে আমদানি করা হয়েছে মাত্র ৬৬ হাজার ৩০ মেট্রিক টন ছোলা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছোলা আমদানি হয়েছে ৭১ হাজার ৬৩৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ১৮ হাজার ২৯১ মেট্রিক টন। মার্চে আমদানি হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ মেট্রিক টন। এপ্রিলে আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন। মে মাসে আমদানি হয়েছে ৮ হাজার ১৫৫ মেট্রিক টন। জুনে আমদানি হয়েছে ৭ হাজার ৪২৩ মেট্রিক টন।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে এক মাস আগে প্রতি মণ ছোলার দাম ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা। সেই ছোলা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায়। এ হিসাবে মণে কমেছে ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা। আর কেজিতে কমেছে ১৩ থেকে ১৬ টাকার মতো। দাম কমার পরও ছোলার সরবরাহ বাড়ছে। তাই আসন্ন রমজানে ছোলার দাম নিম্নমুখী থাকবে, আশা করছেন পাইকারি মোকামের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের জানুয়ারিতে ভালো মানের ছোলা সর্বোচ্চ ৮৫ থেকে ৮৯ টাকায় বিক্রি হয়। বছরের শেষদিকে এটির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। এখন সেই ছোলার পাইকারি দর ৯৫ টাকা।