‘গুড়ুং গুড়ুং’ বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ : মধ্য রাত থেকেই বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে মর্টার শেল ও যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া গোলার বিস্ফোরণে আবারও কাঁপল টেকনাফ সীমান্ত জনপদ। বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত সীমান্তের বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। এতে সীমান্তের একাধিক বাড়িঘরে ফাটল ধরেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকে বুধবার ২০ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, ‘মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত। বারবার বিস্ফোরণের কারণে লবণ চাষি, নাফ নদী ও সাগরের জেলে এবং মাছ ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল লোকজন চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’
শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটের বাসিন্দা নুর কামাল জানান, রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধে আমরা রাতে ঘুমাতে পারিনা। মর্টার শেল ও যুদ্ধ বিমানের গোলার বিকট শব্দ প্রায়ই শুনতে পাই।
টেকনাফ পৌরসভা জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল কাদের জানান, মধ্যরাতে বিস্ফোরণের শব্দ সবচেয়ে বেশি। সীমান্তের কাছে থাকায় মনে হচ্ছে যেকোনো সময় বাড়িতে মর্টার শেল পড়তে পারে।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘রাত থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। তবে তাদের আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। টানা নয় মাস ধরে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্যে আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের আশপাশের একাধিক বিজিপি চৌকি এবং সেনা ক্যাম্প দখল করেছে’।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আরিফ উল্লাহ নিজামী বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের বিস্ফোরণের বিকট শব্দ টেকনাফ সীমান্তেও শোনা গেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কোস্ট গার্ড ও বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সীমান্তবাসীর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে’।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে ব্যবহ্নত মর্টার শেল ও গুলির বিকট শব্দে আবারও কাঁপছে উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত থেমে থেমে ভেসে আসে বিকট শব্দ। এতে ঘুমধুম ও পালংখালী ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে।
জানা যায়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যোদ্ধাদের সঙ্গে চলছে সংঘর্ষ। ঘুমধুম ও উখিয়ার পালংখালী সীমান্তের ওপারে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামগুলোতে সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে ঘুমধুম ও পালংখালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে।
পালংখালী সীমান্ত এলাকার গণমাধ্যমকর্মী রফিক মাহমুদ বলেন, মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট থেকে শুরু করে থেমে থেমে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ভারি গোলার শব্দ এপারে শুনা যাচ্ছে। যার কারণে সীমান্ত এলাকায় অযথা না যাওয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ঘুমধুম এলাকার হামিদুল হক বলেন, মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে মিয়ানমারের মর্টার শেলের শব্দ হয়। মিয়ানমার থেকে ৫৬ জন তংচগ্যা ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে উখিয়া হিন্দু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে আশ্রয় নেওয়ার একদিনের মাথায় বহুদিন পর আবার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন। এতে সীমান্তবর্তী বসবাসকারী লোকজন ভয়ের মধ্যে আছেন।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম, গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কিছুদিন বন্ধ থাকার পর পালংখালী সীমান্তের ওপারে ভারী গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকার লোকজন আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। একদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলির শব্দ অন্যদিকে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। আমরা সীমান্তবাসী দুশ্চিন্তায় আছি। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষা রয়েছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার ও ক্যাম্পের গোলাগুলির শব্দে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে ভয় কাজ করছে। মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে ঘুমধুম বাইশফাঁড়ি সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে চাকমা ও বড়ুয়া পরিবারের ৫৬ জন সদস্য অনুপ্রবেশ করেছে। তারা বর্তমানে উখিয়ার কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় প্রশাসনের নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছে। গত এক সপ্তাহ আগে ১২ জন এবং সোমবার (১৮ নভেম্বর) চাকমা পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৪৫ জন অনুপ্রবেশ করে। তাদের কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় রাখা হয়েছে। সম্প্রতি পালংখালী নাফ নদে ৫ জন জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। তাদের মধ্যে এক জনের মরদেহ স্থানীয়দের সহযোগীতায় উখিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করেছিল। ##